গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো- গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ উপসংহার - Gupta samrajyer pataner karaṇ

 গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ 

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো

গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি ও পতন 

 উত্থান ও পতন ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়ম। যে অপ্রতিহত শক্তি সাময়িকভাবে সকলের শ্রদ্ধা, বিস্ময় ঈর্ষা এবং ভীতির উদ্রেক করে অদূর ভবিষ্যতে তারও গৌরবরবি অস্তমিত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে নি। সমুদ্রগুপ্ত যে সাম্রাজ্যকে সর্বভারতীয় রূপদান করেছিলেন, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যার আয়তনকে আরও বৃদ্ধি করেছিলেন, সেই বিশাল সাম্রাজ্য তাঁদের মৃত্যুর একশত বছরের মধ্যেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত বংশ উন্নতির চরম শীর্ষস্থানে আরোহণ করেছিল এবং খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই পতনের সূত্রপাত হয়েছিল।



পরবর্তী গুপ্ত শাসকগণ 

পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহ প্রথম কুমারগুপ্ত :  দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ‘মহেন্দ্রাদিত্য' উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি খুব সম্ভবতঃ ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৪৫৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। প্রথম কুমারগুপ্তের শাসন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় নি, তবে মুদ্রা এবং শিলালেখ থেকে যে সকল তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয় যে, তাঁর সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আয়তন হ্রাস পায় নি। পুর্বদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত এই সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। তিনি যে শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন তা তাঁর দ্বারা অনুষ্ঠিত অশ্বমেধ যজ্ঞের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। তাঁর রাজত্বের প্রথমভাগে যে হুন আক্রমণ হয়েছিল তিনি সেই আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। কিন্তু এই শক্তিশালী শাসকের রাজত্বের শেষদিকে নর্মদা অঞ্চলের পুষ্যমিত্ররা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যুবরাজ স্কন্দগুপ্তকে এই বিদ্রোহ দমন করতে পাঠানো হয়েছিল। স্কন্দগুপ্ত এই সংকট থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে সম্রাট কুমারগুপ্তের যশ ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখেন। কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর স্কন্দগুপ্ত এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করেছিলেন।

স্কন্দগুপ্ত ও হুন আক্রমণ : প্রথম কুমারগুপ্তের পর তাঁর প্রথম পুত্র স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্কন্দগুপ্তই গুপ্ত বংশের শেষ পরাক্রান্ত সম্রাট। তিনি ৪৫৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৪৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় যে স্কন্দগুপ্ত কুমারগুপ্তের সন্তানদের মধ্যে যোগ্যতম বলে কুমারগুপ্ত তাঁকেই রাজপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই স্কন্দগুপ্ত নিজ কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহ দমন ছাড়াও যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত আর এক কঠিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতবর্ষ তথা গুপ্ত সাম্রাজ্য বর্বর হন জাতির আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল। সিংহাসনে আরোহণের পর স্কন্দগুপ্তের সর্বপ্রধান কৃতিত্ব হল হুন আক্রমণ থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা। স্কন্দগুপ্ত হুন জাতিকে এমনভাবে যুদ্ধে পরাজিত করেন যে, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তারা আর ভারত আক্রমণে সাহসী হয় নি। এই আক্রমণ থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকেও বর্বর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন। সামরিক সাফল্যই স্কন্দগুপ্তের একমাত্র কৃতিত্ব নয় । তিনি বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের জন্য সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রাখেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের মত উদার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছিলেন। সুদক্ষ যোদ্ধা ও সুশাসক স্কন্দগুপ্ত সুবিখ্যাত গুপ্ত রাজবংশের শেষ সার্থক সম্রাট।‘কথাসরিৎসাগর’ থেকে স্কন্দগুপ্ত ও বিক্রমাদিত্যের কার্যকলাপ আমরা জানতে পারি ।


স্কন্দগুপ্তের দুর্বল উত্তরাধিকারীগণ : স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। তবে একথা সত্য যে, তাঁরা হুন আক্রমণের বিরুদ্ধে সার্থক প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। গুপ্তযুগের বংশ-তালিকা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ধারিত হয় নি। বুধগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত প্রভৃতি বহু নাম শিলালেখ থেকে পাওয়া যায়। তবে তাঁদের মধ্যে কে কে প্রধান গুপ্ত বংশের শাসক এবং কারাই বা শাখা বংশের, ঐতিহাসিকগণ আজও তা সঠিকভাবে স্থির করতে পারেন নি। এই যুগের একমাত্র বুধগুপ্ত সম্বন্ধে কিছু সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর সময়ে অর্থাৎ ৪৭৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্য অটুট ছিল। তারপর থেকেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের আয়তন ও ক্ষমতা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। হুন দলপতি তোরমান এবং মিহিরগুল ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ক্রমক্ষীয়মান গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছিলেন।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হঠাৎ ঘটেনি। তার অবনতি অনেকদিন ধরে চলেছিল। এই পতনের অনেক কারণ ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন কারণের উল্লেখ করেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গুপ্ত বংশীয় সম্রাটদের পরিবারে অভ্যন্তরীণ কলহ, সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও সম্রাটদের দুর্বলতা।


ক ) পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহ : প্রথমত, কুমারগুপ্তের শাসনকালে নর্মদা নদীর উপত্যকা অঞ্চলের পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহ গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে প্রথম প্রবল আঘাত হেনেছিল। যদিও এই বিদ্রোহ যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত দমন করেছিলেন তথাপি এই বিদ্রোহ যে সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করেছিল, তা অনস্বীকার্য।


খ ) হল আক্রমণ : দ্বিতীয়ত, পুষ্যমিত্রদের বিদ্রোহে বিভ্রান্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যকে বৈদিশেক হুনগণ আক্রমণ করে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে এই বর্বর জাতি ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মধ্য ভারত পর্যন্ত তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কুমারগুপ্তের আমলে হুন আক্রমণ প্রতিরোধ করা হলেও পরবর্তী ১০০ বছর ধরে ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিহত করা দুর্বল গুপ্ত শাসকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তোরমান এবং মিহিরগুলের নেতৃত্বে হুন  করার মত শক্তি মুমূর্ষু গুপ্ত সাম্রাজ্যের ছিল না। পরবর্তীকালে এই হুন আক্রমণ প্রতিহত হয়েছিল সত্য, কিন্তু বারবার আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যে যে ভাঙন ধরেছিল তা রোধ করবার শক্তি দুর্বল গুপ্ত শাসকদের ছিল না।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি লেখ

গ ) প্রাদেশিক শাসন- কর্তাদের উৎপীড়ন : তৃতীয়ত, গুপ্ত সম্রাটদের দুর্বলতা এবং তাদের বিপদের সুযোগ গ্রহণ করে উচ্চপদস্থ রাজকীয় কর্মচারীরা এবং স্থানীয় প্রাদেশিক শাসকগণ ও সামন্তগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন। কনৌজের মৌখরি বংশ, বল্লভীর মৈত্রকগণ, গৌড়ের শাসকগণ গুপ্ত সম্রাটদের আধিপত্য থেকে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এইভাবে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্থলে ছোট ছোট স্বাধীন শাসকদের আবির্ভাব হতে থাকে। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং 'মহারাজা' প্রভৃতি উপাধিগ্রহণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন সূচিত করে এবং শেষ পর্যন্ত পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।গুপ্ত যুগের পতনের কারণ


ঘ ) যশোধর্মন : চতুর্থত, মালবদেশের শাসনকেন্দ্র মান্দাসোরের শাসনকর্তা যশোধর্মনের অভ্যুদয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের -একচ্ছত্র ক্ষমতা চিরদিনের মত বিলুপ্ত করেছিল। যশোধর্মন হুন দলপতি মিহিরগুলকে পরাজিত করেছিলেন। এবং সম্রাট উপাধি গ্রহণ করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ মালবের কোন সামন্ত বংশোদ্ভূত ছিলেন। মান্দাসোরে প্রাপ্ত একটি অনুশাসন লেখ থেকে জানা যায় যে যশোধর্মনের রাজ্য ব্রহ্মপুত্র থেকে আরব সাগর এবং হিমালয় থেকে পূর্বঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর দ্বারা পরোক্ষভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনই সূচিত হয়েছিল।


ঙ ) রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব : পঞ্চমত, পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের দুর্বলতা এবং রাজপরিবারের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বহিরাগতদের আক্রমণ, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা অর্জন যখন গুপ্ত সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তুলেছিল তখন পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটগণ আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলেন। স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী শাসকগণ অনস্বীকার্যভাবে দুর্বল ছিলেন। এছাড়া রাজপরিবারের মধ্যে নানা বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি তাঁরা সামন্তদের সঙ্গে যোগদান করে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে আসেন।


চ ) অর্থনৈতিক কারণ : ষষ্ঠত, অর্থনৈতিক দুরবস্থা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও হ আক্রমণ মোকাবিলা করতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আর্থিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়ে। দেশের বিশৃঙ্খল অবস্থার তাছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে যে অর্থ রাজকোষে আসতো তাও বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক এই সময়েই পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বহির্বাণিজ্যও কমে যায়। সুযোগে সামন্ত রাজারা ও প্রাদেশিক শাসনকর্তারা কেন্দ্রীয় রাজকোষে অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেয়। রাজস্ব আদায়ে গাফিলতি দেখা দেয়।


সর্বশেষে, পরবর্তী গুপ্তশাসকদের ধর্মও গুপ্ত সাম্রাজ্যের জন্য কিছু পরিমাণে দায়ী। পূর্ববর্তী যুগের গুপ্ত শাসকগণ হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী কালের গুপ্ত শাসকগণ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে সামরিক শক্তিকে অবহেলা করতে থাকেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর মহামতি অশোকের ধর্মান্তর গ্রহণের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের যেমন সামরিক এবং রাজনৈতিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল, গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সম্রাটের শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস ছিল সামরিক শক্তি । যখন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণের বিশৃঙ্খলায় সাম্রাজ্যের অস্তিত্বই বিপন্ন সেই সময় সম্রাট কর্তৃক সামরিক শক্তির অবহেলায় স্বাভাবিকভাবে সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে। সামরিক শক্তির দুর্বলতার ফলে প্রাদেশিক শাসনকর্তারাও কেন্দ্রীয় শক্তিকে অস্বীকার করতে সাহন পান। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়। যে, পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটগণ দয়া ও দানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, শৌর্যবীর্যের জন্য নয়।

Post a Comment

0 Comments