Theory of Population by Karl Marx , কার্ল মার্কস কৃত জনসংখ্যা সংক্রান্ত তত্ত্ব

 কার্ল মার্কস কৃত জনসংখ্যা সংক্রান্ত তত্ত  (Theory of Population by Karl Marx)


 “মানুষের মনের সচেতনতা তাদের অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রন করে না, কিন্তু তাদের সামাজিক অস্তিত্ত্ব তাদের সচেতনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।” 

মার্কস বলতে চেয়েছেন যে, মানব সমাজের ইতিহাসে পার্থিব প্রয়োজনসমূহ যেমন খাদ্য, বস্ত্র প্রভৃতির উৎপাদন বিবর্তনের যে কোন সময়ে বা পর্যায়েই ছিল মুখ্য কর্মতৎপরতা। কারণ এই কর্মতৎপরতাই জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার পক্ষে অপরিহার্য। উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞান বিকাশ লাভ করে একটি উৎপাদিকা শক্তি হিসাবে। উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি তৈরি হয়। শ্রমবিভাজনের ফলে উৎপাদনে বিশেষীকরণ ঘটে এবং উৎপাদন উদ্বৃত্ত হয়। উৎপাদক অর্থাৎ মালিক শ্রেণি মুনাফা লাভ করে এবং তাদের পুঁজি সঞ্চয় ঘটে। একদিকে মালিক শ্রেণির পুঁজি বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে উৎপাদন ব্যবস্থায় বিশেষীকরণ ও আধুনিকীকরণের ফলে একসময় শ্রমিকের প্রয়োজন কমে আ সে। শ্রমের উদ্বৃত্ত হয়। এভাবে এক উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা সৃষ্টি হয়। মালিকের পুঁজি সঞ্চয় বৃদ্ধি পায় এবং ধনী, দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র শ্রমজীবি জনসংখ্যা বাড়তেই থাকে।


শ্রমসম্পদ বৃদ্ধিঃ 

 ১.  ধনতান্ত্রিক :   ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উক্ত কুফল অর্থাৎ দরিদ্র শ্রমিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকলে দরিদ্র আরো দরিদ্র হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে এবং নিদারুণ দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়। মার্ক্সের মতে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের পরিকাঠামোয় জনসংখ্যা উদ্বৃত্ত হয় না। বরং শ্রমের যোগান বাড়ায় সম্পদ সৃষ্টি বাড়ে। খাদ্যোৎপাদন ছাড়াও অন্যান্য সম্পদ সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত হওয়ার ফলে দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। তাদের খাদ্যোৎপাদন বাড়লে দারিদ্র ঘোচে এবং জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন ঘটে। উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা বাস্তবিক তাই আর উদ্বৃত্ত থাকে না বলে মার্কস মনে করেছেন।

২. সাম্যবাদী : সাম্যবাদী এই জার্মান পণ্ডিত মনে করতেন ম্যালথাস ধনী সমাজের পক্ষে কথা বলেছেন। উদ্বৃত্ত যে জনসংখ্যার কথা মার্কস বলেছেন ধনী শ্রেণি তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়, শোষণ করে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। ধনিক শ্রেণী মুনাফা দ্বারা স্বীয় শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। দরিদ্র জনসংখ্যাকে টিকিয়ে রাখলেই যেন কায়েমী স্বার্থের লাভ। তাই তাদের মধ্যে দরিদ্র জনসাধারণের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য আন্তরিক চেষ্টার অভাব লক্ষ্য করা যায়। শ্রমিক শ্রেণি উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সেই অনুপাতে বাড়ে না।

৩.  দারিদ্র ও শোষণ : দারিদ্র ও শোষণ দরিদ্র দেশগুলির বৈশিষ্ট্য আর এর কারণ পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ। পুঁজিবাদ দ্বারা অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার উপনিবেশগুলির যে মানুষগুলো, তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ম্যালথাস করেছেন বলে মনে করেন মার্কস। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিণতি পজিটিভ চেক্ যা আসে দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, যুদ্ধবিগ্রহের মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে ম্যালথাসের এই মত মার্কসের কাছে গ্রহণীয় নয়।

৪. সুলভ শ্রমিক : সুলভ শ্রমিকের যোগান যাতে অবাধ থাকে এবং শোষণ প্রক্রিয়া থাকে অবিঘ্নিত সেজন্য ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেও উদ্বৃত্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেও জনস্ফীতি বলা হয়েছে। উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা জৈবিক কারণে সৃষ্টি হয় না। সৃষ্টি হয় ধনতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায়। প্রাণিজগৎ বা বৃক্ষজগতে জন্মবৃদ্ধির নিয়মবিধি জনসংখ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন সাধারণীকরণ বা সার্বজনীন নিয়ম প্রযোজ্য নয়।

৫.  পুঁজিবাদী উৎপাদন : শ্রমবিভাজনের ফলে উৎপাদনে বিশেষীকরণ ঘটে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। মালিক মুনাফা লাভ করে। পুঁজি বৃদ্ধি পায়। অধিক মুনাফা লাভের দিকেই লক্ষ্য থাকে। শ্রমিকশ্রেণির শোষণ চলতে থাকে। উদ্বৃত্ত পুঁজি পরিবর্তনশীল পুঁজিতে পরিণত হয় না। কম মজুরিতে কাজ করতে শ্রমিকরা বাধ্য হয়। প্রযুক্তিগত উন্নতিও কলকারখানায় শ্রমিকের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে। ফলে শ্রমিক উদ্বৃত্ত হয় এবং তারা শোষণের স্বীকার হয়। সর্বহারা শ্রমিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এরূপ বৃদ্ধি জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি নয়। মালিক শ্রেণি কর্তৃক অধিক মুনাফা লাভের প্রতিযোগীতায় শ্রমের সংকোচন কৃত্রিমভাবে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মালিক শ্রেণির স্বার্থে এরূপ শোষণযোগ্য উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা টিকিয়ে রাখা হয় সুলভে শ্রমের যোগান অব্যাহত রাখার জন্য। এভাবে যে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা তৈরি হয় তা নিম্নরূপ—

ক) লীন উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা (Latent Surplus Population)  

পুঁজিবাদের প্রথম দিকে শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটে দ্রুত। নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা কলকারখানার সম্প্রসারণ ঘটে। ফলে প্রচুর কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গ্রাম থেকে শহরাভিমুখী জনস্রোত চলে। গ্রামের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ শিল্পকারখানায় কর্মের আশায় গমন করে। এরূপ প্রব্রজনে শিল্পের ও শিল্পমালিকের লাভ হয়। কিন্তু উন্নতি ঘটায় কলকারখানাগুলি অচিরেই অধিকতর যান্ত্রিকীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে শ্রমিকের মজুরি বাঁচাতে এবং উন্নততর ও অধিকতর উৎপাদন অর্জনের লক্ষে। ফলে যান্ত্রীকীকরণ সৃষ্টি করে উদ্বৃত্ত শ্রমিক জনসংখ্যা বা লীন উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা।

খ) ভাসমান উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা (Floating Surplus Population) 

মালিকশ্রেণি স্থির পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে থাকে। নতুন নতুন প্রযুক্তির ও যন্ত্রপাতির প্রয়োগ শুরু করে। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে একদিকে যেমন শ্রমের প্রয়োজন কমে, অপরদিকে প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহারের কলাকৌশলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় প্রচুর সংখ্যায় শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়। তাঁরা জীবিকার তাগিদে একস্থান থেকে অন্যস্থানে। কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় এবং এভাবে তৈরি হয় ভাসমান এবং উদ্বৃত্ত বেকার বা প্রচ্ছন্ন বেকার জনসংখ্যা।

(গ) স্থবির উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা (Stagnant Surplus Population)

পুঁজিবাদী এবং সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় এক শ্রেণির স্থবির শ্রমিকশ্রেণী সৃষ্টি হয়, মালিকের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে। এক ভূমিহীন সর্বহারা স্থবির উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা সৃষ্টি হয়। তারা ভূ-স্বামীর জমিতে কাজ করে, কিন্তু ভূমির উপর তাদের কোনো দাবী থাকে না। শিল্প ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অগ্রবর্তী পর্যায়ে শিল্প শ্রমিকদের একাংশ অনুরূপভাবে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যায় পরিণত হয়। 

মার্কস কর্তৃক সমাধান নির্দেশ : কাল মার্কস জনসংখ্যার এই সমস্যার সমাধান নির্দেশ করেছেন এইভাবে যে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটবে। শ্রমিক শ্রেণির শোষণ বন্ধ হবে। শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত উৎপাদন-জনিত কোনো সমস্যা ঘটবে না। স্থির পুঁজি বৃদ্ধির ঝোঁক কমবে। পরিবর্তনশীল পুঁজি বৃদ্ধি ঘটবে এবং এর ফলে শ্রমিক জনসংখ্যা উপকৃত হবে। শ্রমের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা সৃষ্টি হবার মতো সমস্যা থাকবে না। 

কার্ল মার্কস কৃত জনসংখ্যা সমালোচনা

 ১. উন্নততর প্রযুক্তি শ্রমের সংকোচন ঘটায় এই যুক্তিতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকলে শিল্পোন্নতি ঘটবে না। 

 ২. কেবল শ্রমনিয়োগ করলেই চলবে না, শ্রমিক পিছু উৎপাদনের বিষয়টিও ভাবতে হবে। যাতে কারখানায় লাভ হয় এবং উৎপাদন চালু থাকে। 

৩.   প্রযুক্তিগত উন্নয়ন উৎপাদনের গুনমান বাড়ায়, যা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে জরুরি। এমন প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তির প্রয়োজন যা সকল শ্রমিক জনসংখ্যার মধ্যে থাকে না। ফলে শ্রমিক উদ্বৃত্ত হতে বাধ্য।

৪. কলকারখানায় আধুনিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের মানে শ্রমিকশ্রেণির শোষণ- এই যুক্তিও সর্বত্র প্রযোজ্য নয়।বর্তমানে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশে দেশে আইন প্রণীত হয়েছে। 

৫. কী পরিমাণে শ্রমিক জনসংখ্যা থাকলে উৎপাদন লাভজনক হবে এবং এই সংখ্যা কত সময় পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকবে তা পরিস্থিতির সঙ্গে বদলায়। সুতরাং মার্কস নির্দেশিত উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা তৈরি হবে না।এরূপ কোনো নিশ্চয়তা নেই।

উপসংহার: আপাতভাবে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির শোষণ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির সক্রিয় অংশগ্রহণ এক বিপরীত চিত্র প্রদান করে। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থায় ‘ধনী আরো ধনী হয়, গরীব আরো গরীব হয়- Winslow-র এই উক্তিটি উপেক্ষার নয়। সুতরাং উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা রোধে একদিকে মার্কসীয় দর্শন যেমন অনুসরণযোগ্য তেমনি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য স্থির পুঁজি বৃদ্ধি এবং কলকারখানার আধুনিকীকরণ সমানভাবে প্রয়োজন। সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতি দেশকালের পর্যালোচনায় বিবেচিত হওয়া উচিত।


Post a Comment

0 Comments